রুপান্তর

 আমার ষাট বছর বয়সী বাবা হঠাৎ এক মাঝ রাতে স্ট্রোক করলো। এতে তার শরীরের ডান দিক অবশ হয়ে গেলো। ডান হাত, ডান পা কোনোটাই নাড়াতে পারে না। পুরো শরীর দুর্বল হয়ে গেলো। শোয়া থেকে নিজে উঠে বসতে পারে না, বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারে না। তার ঠোঁট, জিহ্বা বেশ অসাড় হয়ে গেলো। তাই কথা হয়ে গেলো অনেকখানি অস্পষ্ট। অবশ্য মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা যায়।


  বাবা ব্যবসায়ী ছিলো বলে সারাদিন বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকতো। সারাক্ষণ বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকা বাবা আচমকা কাজহীন হয়ে বাড়িতে বন্দী হয়ে গেলো। গোটা দিন বিছানায় শুয়ে থাকে। খাওয়া ও ওষুধ সেবনের সময় হাত দিয়ে ধরে তাকে বসানো হয়। তারপর আবার তাকে শুইয়ে দেয়া হয়। 


  ডাক্তার ওষুধের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যায়াম দিলো বাবাকে করানোর জন্য। আর বললো, তার সাথে যেনো কথা বলি, সময় কাটাই এবং তাকে ধরে ধরে হাঁটতে শেখাই।


  মা সাধ্যমত বাবার সেবা করছে। কিন্তু মা'র বয়স হলো এবং সেও কিছুটা অসুস্থ। তাই মা চাইলেও বাবার জন্য বেশি কিছু করতে পারে না। একমাত্র সন্তান হিসেবে বাবাকে দেখাশোনার দায়িত্বটা ফলে আমার ওপরই সরাসরি পড়লো।  


  বাবার মানসিক জোর খুব ভালো। সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য সে প্রবল চেষ্টা করে। 

  তার পাশে বসলে সে জড়ানো মুখে অনেক কথা বলে। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে কথাগুলো বোঝা সম্ভব নয়। তাকে ধরে ধরে হাঁটানোর সময় সে প্রবল চেষ্টা করে হাঁটার জন্য। 


  সুস্থ হয়ে ওঠার আগ্রহ তার এতো প্রচণ্ড যে, সে আমাকে অস্পষ্ট স্বরে প্রায় ডেকে বলে,"রাব্বি আমার সাথে কথা বল, আমাকে ব্যায়াম করা, আমাকে হাঁটা।"


  প্রথম দিকে আমি তাকে ভালো সময় দিয়েছি। কিন্তু একটা পর্যায়ে তার সাথে সময় কাটানোটা আমার কাছে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করলো। তার জড়ানো কথা শুনতে ভালো লাগে না। ধরে ধরে কিছু সময় হাঁটানোর পর আর ইচ্ছে করে না হাঁটাতে। 


  একদিন তার বিছানার পাশে বসে আছি। সে অস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলে যাচ্ছে। আমার মনোযোগ অন্য দিকে থাকাতে তার কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তার কথা শুনছি না, তবু সে বলে যাচ্ছে। 


  "রাব্বি বুঝলি তারপর কী হলো....সে এক সাংঘাতিক ঘটনা...ঝড় তুফানের রাত...সঙ্গে কেউ নেই...।"

  

  সে বলছে তো বলছে। মনে হচ্ছিলো তার জড়ানো কথাগুলো আলপিন হয়ে আমার শরীরে ফুটছে। আর মাথার ভেতর তাণ্ডব নৃত্য করছে। অসহ্য লাগছিলো আমার কাছে। 


  এক সময় ত্যক্ত হয়ে বললাম,"কী এতো কথা বলো সারাদিন? কিছুই তো বুঝি না। চুপ করে থাকতে পারো না?"


  বাবা মুহূর্তে থেমে গেলো। এবং মাথা নিচু করে বসে রইলো। 


  অন্যদিন বাবাকে হাঁটাচ্ছি। পাশে থেকে তাকে ধরে রেখেছি, আর সে হাঁটছে। আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে সে হাঁটার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওভাবে ধরে ধরে হাঁটানোর অল্প সময় পরই আমার ক্লান্তি চলে এলো। আমি বুঝতে পারছিলাম, এ ক্লান্তি শারীরিক নয়, মানসিক। কারণ তাকে ধরে রেখে হাঁটাতে আমার ভালো লাগছিলো না। 


  কিছুক্ষণ পর তাকে প্রায় জোর করে বিছানায় বসিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,"এখন আর হাঁটার দরকার নেই। বয়স্ক মানুষ এতো হাঁটার প্রয়োজনটা কী? বিশ্রাম করো। পরে হেঁটো।"


  বাবা নিমিষে ম্লান হয়ে গেলো। এবং মাথা নিচু করে বসে রইলো। 


  বাবা এখন আর আমাকে ডাকে না। সে বুঝতে পেরেছে আমার বিরক্তি। আমি নিজ থেকে মাঝে মাঝে যাই। অল্প সময় থেকে চলে আসি। বাবার ঐ অস্পষ্ট কথা আর খুঁড়িয়ে হাঁটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলি। 

  মা যদিও আমাকে কিছু বলে নি, কিন্তু শীতল ব্যবহারে বুঝিয়ে দিলো, আমার আচরণে তিনি অসন্তুষ্ট। 


  এভাবে কিছুদিন যাবার পর এক বিকেলে পার্কে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। সময় কাটাতে অনেকে এসেছে পার্কে। কিছুটা দূরে দেখলাম এক তরুণ বাবা তার ছোট্ট ছেলেকে হাঁটা শেখাচ্ছে। 


  বাবাটি দু হাতে ছেলেকে ধরে একটু একটু করে হাঁটাচ্ছে। ছোট্ট ছেলেটি টলোমলো পায়ে হাঁটছে। বাবা মাঝে মাঝে হাত ছেড়ে দেয়। ছেলেটি দু এক কদম ফেলে মাটিতে পড়ার মুহূর্তে বাবা তাকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে। ছেলেটি যে উৎসাহে হাঁটছে, বাবা তারচেয়ে বেশি উৎসাহে ছেলেকে হাঁটা শেখাচ্ছে। হাঁটার এক পর্যায়ে দেখলাম ছেলেটি ইশারা করছে বাবাকে বসার জন্য। ঘাসের ওপর বাবা ছেলে মুখোমুখি বসলো। তারপর ছেলেটি অবোধ্য শব্দ করে কী সব বলতে লাগলো বাবাকে। আর বাবা দুর্দান্ত আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির কথা শুনে যেতে লাগলো। ছেলের কথা শুনে সে কখনো হাসে, কখনো কান্নার ভান করে, কখনো ভয় পাওয়ার ভান করে। যেনো ছেলেটি ভীষণ সুন্দর কোনো গল্প বলছে আর বাবাটি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। পুরো বিকেল জুড়ে বাবা আর ছেলের কাণ্ড দেখলাম। বাবা ছেলেটিকে কখনো হাঁটাচ্ছে, কখনো গল্প করছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি মুহূর্তের জন্যও বাবার মুখে ক্লান্তি কিংবা বিরক্তি দেখলাম না। শুধু দেখলাম ছেলের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। 


  বাবা আর ছেলেকে দেখতে দেখতে এক সময় ভুলে গেলাম কোথায় আছি। আমি যে বন্ধুদের সাথে আছি এটা মনেই পড়লো না। আমার মাথায় তখন অন্য কিছু। 


  বন্ধুরা এক সময় টের পেলো আমার অন্যমনস্কতা। 

  তারা জানতে চাইলো,"কীরে রাব্বি কী হয়েছে তোর? এমন ঝিম মেরে গেলি?"


  আমি গাঢ় নীরবতা ভেঙে কোনো রকমে বললাম,"কিছু না। আমি ঠিক আছি।"

  কিন্তু আমি জানি, আমি ঠিক নেই। আমার মাথায় তখন অন্য কিছু। অন্য ভাবনা।


  সন্ধ্যায় বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আর এক গুচ্ছ তাজা ফুল কিনে বাড়ি ফিরলাম। 

  পাঞ্জাবি আর ফুলগুলো বাবার হাতে দিয়ে বললাম,"তুমি যে আমাকে এখন আর ডাকো না বাবা? তোমার সব গল্প তো এখনো শোনা হয় নি। আর না হাঁটলে কি চলবে? কতো পথ যে এখনো তোমার পেরুনোর বাকি!"


  বাবা অবাক এবং কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকালো। কী বুঝলো জানি না। দেখলাম তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো ভীষণ আনন্দ। 


  তারপর সে অদম্য উৎসাহ নিয়ে জড়ানো উচ্চারণে বললো,"বুঝলি রাব্বি...আমি তখন যুবক...বুক ভরা স্বপ্ন সাহস...ঠিক তোর মতো...।"


  বাবা বলছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। কখনো হাসছি, কখনো কান্নার ভান করছি, কখনো ভান করছি ভয় পাওয়ার। 

  মা কাজ করার ফাঁকে দৃশ্যটি দেখে মিষ্টি হাসলো। 


  এরপর বাবাকে ধরে ধরে হাঁটানোর সময় হঠাৎ মনে হলো, আমার আর বাবার ভূমিকা বদলে গেলো। এখন আমি হলাম তরুণ বাবা। আর সে হলো ছোট্ট শিশু। 


  আমি বাবার গল্প শুনি, তাকে ধরে হাঁটাই আর মনে মনে বলি,"হে প্রভু, তুমি আমার বাবা মা'কে ভালোবাসো। যেমনি ভাবে তারা আমাকে শৈশবে পরম ভালোবেসে লালন পালন করেছিলো।"



Comments

Popular posts from this blog

কোলবালিশ

দ্বিতীয় ছেলেটা