গোয়েন্দা

 "ধাক্কা দিচ্ছেন কেন?" সামনে থেকে কর্কশ গলায় প্রশ্নটা উড়ে আসলো। চমকে গিয়ে একটু পেছনে সরে আসল রানা। 

লোকাল ট্রেনের ভেতরে ভীড়ের চাপে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই ঝামেলা হয়ে গেছে। আর ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয়ার মত এতটাও অভব্য না রানা। এর থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে ওর!

এক হাতে উপরের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে কিছুটা ঝুঁকে হাতের মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকাল রানা। কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান প্লে করলো একটা। ট্রেনের দুলুনিতে খারাপ লাগছে না শুধু ওই মানুষের ভিড়টাই যা একটু বেশি। অবশ্য ভিড় যত বেশি ততই ভালো ওর জন্য।

কাজটা ঠিকঠাক ভাবে করার জন্য আরো ভিড় থাকলে আরো বেশি ভালো হতো, তবে এটুকুতেই চলবে। কাঁচা কাজ করে না রানা। ওর বা পাশে ওর মতোই ইয়ারফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। বয়স ওর মতোই হবে। তবে রানার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছেলেটার ওপাশে, লাল শার্ট পরা লোকটার দিকে। 

লোকটাকে দেখতে মনে হয় একদম নিরীহ, সহজ সরল তবে তার এই সরল চেহারা দিয়ে রানার কোন লাভ নেই। কেননা রানার আজকের টার্গেট এই লোকটাই। 

তিন দিন ধরে লোকটার উপর নজর রাখছে সে, কাজটা করতে হবে আজকেই, এই ট্রেনেই। সাধারণত কোন কাজের জন্য রানা তিন দিনের বেশি সময় নেয় না, এক্ষেত্রেও তাই করেছে। তিনদিন সময় তার কাছে যথেষ্ট।

রানার অল্পবয়স্ক এই চেহারা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই দেশের সবচেয়ে  ভয়ঙ্করতম গোপন এক সংস্থার হয়ে কাজ করে সে। গত ছয় মাসে রানার হাতে খুন হয়েছে ৭ জন। যে কেইস গুলোর কোন কূল কিনারাই করতে পারেনি পুলিশ। পারবেও না কোনদিন, আপন মনে হাসল রানা। নিজের কাজের উপর নিজের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে তার। 

এমন একটি সংস্থার হয়ে রানা কাজ করে যে সংস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কেও কারো কোন ধারণা নেই। এই সংস্থায় কয়জন কাজ করে, কে এই সংস্থার নিয়ন্ত্রণ করে সে সম্পর্কেও কোন কিছু জানে না কেউ। 

এমনকি এদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারখানেক এজেন্টরা সবাই বিচ্ছিন্নভাবে রিক্রুটেড হয়! যারা যারা এ সংস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে তাদের প্রত্যেকের কাছে একটা কোড টেক্সট আসে। মেসেজে থাকে পরবর্তি টার্গেটের নাম এবং ঠিকানা। তারা কাজ শেষ করে মেসেজ এর রিপ্লাই দেয় একটি ছোট্ট কোড মেসেজের মাধ্যমে, "Done, Waiting For the NEXT"

ওদের পেমেন্ট ওরা পেয়ে যায়!

এত গোপন একটা অর্গানাইজেশন কিভাবে আইনের নাকের ডগায় বসে তাদের কাজ করে চলেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না রানা। এটুকু বুঝতে পারে অনেক ওপর মহলেরও সম্পৃক্ততা আছে এদের সাথে! একের পর এক হাই প্রোফাইল কেস থেকে শুরু করে পাশের বাসার ঝগড়াটে প্রতিবেশীকে সরিয়ে দেয়া? এভরিথিং! 

রানা কিভাবে এই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে গেল সে নিজেও জানে না! শুধু জানে এখান থেকে আর কোনদিনও বের হতে পারবে না। ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো সে।

লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো আবার। দেখলে মনেও হবে না খুব বড় কোন মানুষ। কেন কেউ এই লোকটাকে মারতে চাইবে সেটা তার মাথায় এলো না। তিন দিন আগে যখন এ লোকটার কন্ট্রাক্ট সে পেল তখন থেকে লোকটাকে নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছে।

একদম সহজ সরল জীবনযাপন লোকটার। প্রতিদিন সকালে অফিস, দুপুরে লাঞ্চ বাইরের কোন হোটেলে আর প্রত্যেক সন্ধ্যায় লোকাল ট্রেনে করে বাড়ি ফেরা। একটু হাসলো রানা, সেও তো প্রতি সকালে অফিসের জন্য বের হয়। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে বলে জানে পরিবারের সবাই। করেও একটি চাকরি ছোটখাটো। শুরু হয় সকাল আটটায়, শেষ হয় দুপুর তিনটায়। নিতান্তই সামান্য কিছু টাকায়। 

আর তার মূল কাজ শুরু হয় বিকাল থেকে। মেসেজ- ইনফর্মেশন- ফলোইং!

রানার খুন করার হাতিয়ারটা খুবই সাধারন। ছোট্ট একটি আঙুলের সমান সিরিঞ্জ, যার ভিতরে থাকে প্রচন্ড বিষাক্ত এক তরল যার কার্যক্ষমতা সায়ানাইড এর থেকেও বহু গুন বেশি। ভিড়ের মধ্যে শুধু আলতো করে ঘাড়ের ঠিক নিচে সুই ঢুকিয়ে দিলেই কাজ শেষ, বড়জোর দশ সেকেন্ড!

লাল শার্ট পরা লোকটা ঘামাচ্ছে। বারবার কপাল থেকে ঘাম মুছছে। পরবর্তী কাজগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে রানা!

সামনের স্টেশন এসে গেছে। ট্রেন এখনই থামবে। ট্রেন থামার পর পর মানুষ হুড়মুড় করে নামার চেষ্টা করবে ঠিক তখনই লাল শার্ট ওয়ালার পিছনে গিয়ে দাঁড়াবে ও, ভিড়ের মধ্যে আলতো করে ঘাড়ের নিচে ছোট্ট করে একটা পুশ, ব্যাস তার কাজ শেষ।

ট্রেন থেমেছে। সবাই নামার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দিয়েছে। ভিড় ঠেলে ঠিক লাল শার্টের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো রানা। সাবধানে সিরিঞ্জটা পকেট থেকে বের করে আঙুলের ফাঁকে নিতেই হঠাৎ করে লাল শার্টওয়ালা লোকটা কি মনে করে তার দিকে ফিরে তাকাল। আর তখনই সামনের গেটে মানুষের ধাক্কায় রানার গায়ের উপর এসে পড়ল লোকটা। 

হঠাৎ করে ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব রানা লোকটাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে হঠাৎ করে খেয়াল করল, তার ঠিক গলার নিচে সুই ফুটার মত তীক্ষ্ণ একটা অনুভূতি। হতবুদ্ধি হয়ে রানা দেখলো লোকটার হাতে হুবুহু তারটার মতোই একটা সিরিঞ্জ, যেটার সুইটা ফুটে আছে রানার গলার ঠিক নিচটায়! 

রানার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে নেমে গেলো লাল শার্ট পরা মানুষটা। নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো রানার প্রাণহীন দেহ ট্রেনের বগিতেই।

প্লাটফর্ম ধরে হাটতে হাটতে পকেট থেকে ছোট্ট একটা মোবাইল বের করলো লাল শার্টওয়ালা। একটা মেসেজ টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো, "Done, waiting for the NEXT"

[সমাপ্ত]


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রুপান্তর

কোলবালিশ

দ্বিতীয় ছেলেটা